মাকে প্রতিদিন স্ট্রেস কমানোর জন্য যে ৭ টি কাজ করতে হবে

PrintableColorPal
0



“মা হওয়া যেন একটা ২৪ ঘণ্টার চাকরি, ছুটি নেই, ছাড় নেই, কিন্তু দায়িত্ব অসীম।”
এই কথাটা আগে শুনলেও মা হওয়ার পর সেটা বুকের ভেতর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।

আমার গল্পটা একটু বলি।

সকাল ৬টায় ঘুম ভাঙে।
ছেলেটার স্কুল, স্বামীর অফিস, রান্না, বাসার কাজ—সব সামলাতে সামলাতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে যায়, বুঝতেই পারি না। নিজের খাওয়া, গোসল, এমনকি বসে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগও হয় না অনেকদিন।

একদিন দুপুরে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম রান্নাঘরে। ডাক্তার বললেন, “আপনার শরীর ক্লান্ত না, আপনার মন ক্লান্ত।”
সেই দিন থেকেই আমি বুঝলাম—‘আমি যদি ভালো না থাকি, তাহলে আমার চারপাশের কেউই ভালো থাকতে পারবে না।’

আজ আমি যা শিখেছি, সেটাই আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
একজন মা প্রতিদিন নিজেকে ভালো রাখার জন্য যেসব ছোট ছোট কাজ করতে পারেন, তার মধ্যে ৭টি এখানে বলছি—যেগুলো আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

১. দিনের শুরুটা নিজের মতো করে শুরু করুন




 আগে সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে যেতাম বাচ্চাকে গোসল করাতে, টিফিন বানাতে।

কিন্তু এখন আমি ২০ মিনিট আগে উঠি।
চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়াই, এক কাপ চা খাই, আকাশ দেখি।

এই ২০ মিনিট শুধু আমার নিজের জন্য।
তখন কেউ আমাকে “মা” ডাকে না। আমি শুধু “আমি”।

কি করবেন:

  • সকাল ১৫–২০ মিনিট আগে উঠুন।

  • নীরবে বসে থাকুন, কিছু লিখুন, প্রার্থনা করুন বা ধ্যান করুন।

  • নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলুন।

২. শরীরকে ভালোবাসুন—হালকা ব্যায়াম করুন



একবার একটা ভিডিও দেখেছিলাম—“মা যতটা শক্ত মানসিকভাবে, তার শরীরও ততটা শক্ত হওয়া উচিত।”
আমার হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছিল, কোমরেও টান লাগত।
ডাক্তার বললেন—প্রতিদিন হালকা ২০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করলেই অনেকটা উপকার পাবেন।

প্রথমে ইচ্ছে করত না, কিন্তু এক সপ্তাহ করার পর বুঝলাম—শুধু শরীর না, মনটাও হালকা হয়ে যায়।

কি করবেন:

  • প্রতিদিন ১৫–২০ মিনিট হালকা হাঁটুন বা স্ট্রেচিং করুন।

  • ইউটিউব থেকে “easy morning workout for moms” দেখে নিতে পারেন।

  • শিশুটিকে পাশে রেখে হালকা ব্যায়াম করলে সেও আনন্দ পায়।

৩. নিজের প্রিয় জিনিসগুলোতে ফিরে যান



আমি আগে খুব গান শুনতাম, গল্পের বই পড়তাম। কিন্তু মা হওয়ার পর যেন সে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম।
একদিন স্বামী বলল, “তুমি তো একসময় রবীন্দ্রনাথের বই খুব পড়তে, এখন কেন পড়ো না?”
সেই কথা শুনে বুকটা যেন কেঁপে উঠল। আমি তো সত্যিই হারিয়ে গেছি।

তখন থেকে আবার একটু একটু করে গান শোনা, বই পড়া শুরু করলাম।

কি করবেন:

  • পুরনো কোনো শখে ফিরে যান—আঁকা, গান, বই, হস্তশিল্প।

  • দিনে অন্তত ১৫ মিনিট নিজের প্রিয় কিছুর জন্য রাখুন।

  • গিল্টি ফ্রি হয়ে উপভোগ করুন।

৪. “না” বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন



আমার ছোট বোন একদিন বলল, “তুমি না একদম নিজের জন্য ‘না’ বলতে পারো না!”
তখন বুঝলাম—আসলে আমরা মায়েরা সবসময় অন্যের কথা শুনতে শুনতে নিজের চাওয়াগুলোকে গিলে ফেলি।

একদিন বাসায় একটা অনুষ্ঠান ছিল। সবাই চাইছিল আমি রান্না করি।
কিন্তু আমি বললাম, “আজ আমি পারব না, খুব ক্লান্ত।”

সেই “না” বলার সাহসটাই আমাকে ভেতর থেকে একটু শক্ত করেছিল।

কি করবেন:

  • সব দায়িত্ব একা নিতে যাবেন না।

  • ক্লান্ত হলে “না” বলুন, কৌশলে।

  • নিজের চাওয়াগুলোকে গুরুত্ব দিন।

৫. সামান্য রুটিন মেনে চলুন

প্রথম দিকে আমার দিন ছিল এলোমেলো। কিছুই সময়মতো হতো না।
বাচ্চা কাঁদছে, আমি রান্না করছি, হঠাৎ ফ্যান বন্ধ, দুধ উথলে পড়ছে—পুরো একটা বিশৃঙ্খলা।

পরে আমি একটা ছোট্ট রুটিন বানালাম।
সকালে কি করবো, দুপুরে কি করবো, এমনকি কখন একটু বসে বিশ্রাম নেব—সব লিখে রাখতাম।

এতে দিনটা কিছুটা গুছিয়ে আসল।

কি করবেন:

  • মোবাইলের নোটে বা একটা খাতায় দিনভিত্তিক ছোট্ট রুটিন লিখুন।

  • একসাথে সব কাজ না করে ভাগ করে করুন।

  • রুটিন মানতে না পারলে চাপ নেবেন না—এটা শুধু একটা গাইডলাইন।

৬. মানসিক শান্তির জন্য একটু 'ডিজিটাল ডিটক্স' করুন

সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য মায়েদের ‘পারফেক্ট’ ছবি দেখে নিজের জীবনকে এলোমেলো মনে হতো।
সবাই কেন এত ‘সাজানো গোছানো’, আর আমি কেন এত এলোমেলো?

পরে বুঝলাম—ওগুলো বাস্তব না।
তখন থেকে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা ফোন একেবারে বন্ধ রাখি। শুধু আমি আর আমার ছোট্ট পৃথিবী।

কি করবেন:

  • দিনে অন্তত ১ ঘণ্টা মোবাইল থেকে দূরে থাকুন।

  • বাচ্চার সঙ্গে খেলুন, বই পড়ুন বা বারান্দায় বসুন।

  • রাতের বেলা ঘুমানোর আগে স্ক্রিন ব্যবহার কমান।

৭. মনের যত্ন নিন—ভালোবাসার কথা বলুন নিজের সঙ্গে

আমরা অনেক সময় নিজেকে খুব কটু কথা বলি—“আমি ব্যর্থ মা”, “আমার দ্বারা কিছু হবে না”।
এইসব কথা আমাদের মনকে আরও অসুস্থ করে তোলে।

একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “তুমি যথেষ্ট করছো। তুমি ভালো মা।”
শুনতে হাস্যকর মনে হলেও বিশ্বাস করুন—এই কথাগুলো শুনে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

কি করবেন:

  • নিজের প্রশংসা করুন, প্রতিদিন অন্তত ১ বার।

  • কৃতজ্ঞতা লিখুন: “আজ আমি যা ভালো করলাম।”

  • নিজেকে জড়িয়ে ধরুন মনে মনে।

উপসংহার:

আমরা মায়েরা সর্বদা নিঃস্বার্থভাবে দিতে শিখেছি।
কিন্তু দিন শেষে, একজন সুস্থ, হাসিখুশি, মানসিকভাবে শক্ত মা—তার সন্তান ও পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।

আপনার হাসিই আপনার সন্তানের নিরাপত্তা, আপনার শান্তিই আপনার পরিবারের আশ্রয়।

তাই আজ থেকে প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় রাখুন নিজের জন্য।
নিজেকে একটু ভালোবাসুন, কারণ আপনি যে শুধু একজন “মা” নন, আপনি একজন পূর্ণ মানুষ।


Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)